"ইসতাওয়া" ( اسْتَوَى ) নিয়ে সংক্ষেপে মৌলিক কিছু কথা
কিছুদিন যাবত "ইসতাওয়া" ( اسْتَوَى ) নিয়ে বেশ আলোচনা পর্যালোচনা হচ্ছে । তাই ইচ্ছে হল ইসতাওয়া ( اسْتَوَى ) সম্পর্কে সংক্ষেপে মৌলিক কিছু কথা লিখি । আল্লাহ্ তাওফিক দান করুন । আমিন
আল্লাহ্ তালা কোরআনে বলেনঃ (ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ )
কোরআনে বর্ণিত শব্দ ( اسْتَوَى ) "ইসতাওয়া" শব্দটির অর্থ করা হবে, না হবে না, এই দৃষ্টিকোণ থেকে দুই মাজহাবঃ
১ – এক মাজহাব বলেনঃ ইসতাওয়া শব্দটির কোন অর্থ করা হবে না ।
তাদের বক্তব্য হলঃ ইসতাওয়া শব্দটির শাব্দিক অর্থ হল কোন স্থানে থাকা বা সমাসীন হওয়া বা আয়ত্তাধীন হওয়া । ইত্যাদি । কিন্তু আল্লাহ্ তালা শরীর বা স্থান থেকে চির পবিত্র । তাই শব্দটির বাহ্যিক অর্থ আল্লাহ্ র ক্ষেত্রে অসম্ভব । সুতরাং আয়াতটি সম্পর্কে আমরা এই বিশ্বাস রাখবো, আল্লাহ্ নিজ শান অনুযায়ী আরশে ইসতাওয়া । তখন ( اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ ) এর অর্থ হবেঃ আল্লাহ্ আরশে ইসতাওয়া ।
এই আয়াত সম্পর্কে অধিকাংশ আহলে সুন্নাত ও জামাতের আকিদা এটা এবং মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রঃ এবং মুফতি তাকী উছমানী দাঃ বাঃ এর আকিদা এটাই । আমিও আলহামদুলিল্লাহ্ এই আয়াত সম্পর্কে এই আকিদা রাখি ।
২ - আরেক মাজহাব বলেনঃ ইসতাওয়া ( اسْتَوَى ) শব্দটির অর্থ করা হবে । কিন্তু এটা কী আল্লাহ্ র সত্ত্বাগত সিফাত, না কর্মগত সিফাত ? এই দৃষ্টিকোণ থেকে এখানেও দুই মাজহাব ।
সত্ত্বাগত সিফাত এবং কর্মগত সিফাত কাকে বলে, আগে এটা একটু বুঝে নিলে, আমার মনে হয় পরবর্তী আলোচনা বুঝা সহজ হবে । ইন সা আল্লাহ্ ।
আল্লাহ্ তালার সত্ত্বাগত সিফাত হল, যেমনঃ আল্লাহ্ সব কিছু জানেন । আল্লাহ্ সব দেখেন । আল্লাহ্ সব শুনেন । আল্লাহ্ সকল কিছুর উপর পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন । ইত্যাদি ।
আল্লাহ্ তালার কর্মগত সিফাত হল, যেমন, আল্লাহ্ সকল কিছুর স্রষ্টা । আল্লাহ্ই একমাত্র রিজিক দাতা । আল্লাহ্ই একমাত্র জীবন দান করেন । আল্লাহ্ই একমাত্র মৃত্যু দান করেন । ইত্যাদি । এগুলো আল্লাহ্ কর্মগত সিফাত এবং এই কর্মগুলো আল্লাহ্ র ইচ্ছা অনুযায়ী মাখলুকের মাঝে সম্পাদন হয় ।
উপরের মূলনীতিটা বুঝে থাকলে, আশা করি সহজেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন । ইন সা আল্লাহ্ ।
যারা বলেনঃ ইসতাওয়া ( اسْتَوَى ) শব্দটির অর্থ করা হবেঃ তাদের দুটি মাজহাবঃ
১ – এক মাজহাব বলেনঃ "ইসতাওয়া" এটা হল আল্লাহ্ তালার সত্ত্বাগত সিফাত এবং استوى শব্দটির অর্থ হল علا । তখন ( اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ ) এই আয়াতের অর্থ হবেঃ আল্লাহ্ আরশে সমুন্নত ।
উঁচু হওয়া এবং সমুন্নত হওয়া এটা আল্লাহ্ র সিফাত যেমন আল্লাহ্ কোরআনে বলেনঃ
وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ
তিনিই সমুন্নত, মহান । ( সুরা বাকারা ২৫৫ )
ইমাম ইবনে বাত্তাল রঃ এই মতকে সঠিক বলেছেন । এবং বলেছেন এটাই আহলে সুন্নাত ও জামাতের মত ।
তবে মনে রাখতে হবে, এখানে উদ্দেশ্য হল মর্যাদাগত দিক থেকে সমুন্নত বা সর্বোচ্চ হওয়া, স্থানগত দিক থেকে নয় । আমি এই পার্থক্যটা নিয়ে #আকিদা_৩৫ য়ে লিখেছি । আলহামদুলিল্লাহ্ ।
২ – আরেক মজাহাব বলেনঃ ইসতেওয়া ( اسْتَوَى ) আল্লাহ্ র কর্মগত সিফাত ।
এরা আবার কয়েক দলে বিভক্ত । তবে প্রসিদ্ধ দুটি মাজহাব উল্লেখ করছিঃ
ক – এক মাজহাব বলেনঃ ইসতেওয়া ( اسْتَوَى ) এর অর্থ হল ( استولى ) প্রভাব বিস্তার করা । এই শব্দ অনুসারে ( اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ ) এই আয়াতের তরজমা হবেঃ আল্লাহ্ আরশের উপর নিজ ক্ষমতা বা প্রভাব বিস্তার করলেন ।
খ – আরেক মাজহাব বলেনঃ ইসতাওয়া ( اسْتَوَى ) শব্দটির অর্থ হল ( الصعود .الارتفاع . العلو . الاستقرار ) "ইসতাওয়া" শব্দটির অর্থ হলঃ
১ - আরোহণ করা ।
২ - ঊর্ধ্বগমন করা ।
৩ - স্থানগত ভাবে সমুন্নত হওয়া ।
৪ - স্থায়ীভাবে অবস্থান করা ।
ইমাম ইবনুল কাইউম রঃ তার উস্তাদ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ থেকে "ইসতাওয়া" শব্দটির অর্থ হিসাবে এই চারটি অর্থ উল্লেখ করেন । ( নুনিয়্যাতু ইবনিল কাইউম রঃ )
নামধারী সালাফিরা ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ অনুসরণে ইসতাওয়া শব্দটির এই চারটি অর্থ করে থাকেন । আবার কেউ কেউ আরেকটু আগে বেড়ে ইসতাওয়া শব্দটির তরজমা করেনঃ ( جلس أو قعد ) বসা । তবে সালাফিদের অনেকে আছেন, যারা বসার আকিদা রাখেন না এবং বসার মর্মে যত বর্ণনা আছে, সেগুলোকে তারা সঠিক বলেন না । আবার কেউ কেউ এই ভাবেই বলেন, এই বিষয়ে ( "ইসতাওয়া" এর অর্থ বসা ) এই মর্মে কোন সহি বর্ণনা নেই ।
তবে তাদের কারো কারো কিতাবে ইসতাওয়া এর অর্থ ( جلس أو قعد ) বসার অর্থের বর্ণনা পাওয়া গেলেও, বসার আকিদা নির্ভরযোগ্য সালাফিরা রাখেন না বরং ইমাম ইবনুল কাইউম থেকে বর্ণিত চারটি শব্দ দ্বারাই তারা ইসতাওয়া শব্দটির ব্যাখ্যা করে থাকেন ।
উল্লেখিত চারটি শব্দ যদিও এখন আমরা ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ দিকে সম্পৃক্ত করে পাচ্ছি । কিন্তু ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ পূর্বে একটি দল ইসতাওয়া শব্দের অর্থ করতেন ( استقر ) স্থায়ীভাবে অবস্থান করলেন ।
এখন প্রশ্ন ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ আগে কারা করতো এই অর্থ ?
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ আগের বিখ্যাত আলেম, ইমাম ইবনে বাত্তাল বলেনঃ
قالت الجسمية : معناه الاستقرار ...... وأما قول المجسمة ففاسد أيضا لأن الاستقرار من صفات الأجسام ويلزم منه الحلول والتناهى وهو محال في حق الله تعالى ولائق بالمخلوقات .
দেহবাদী আকিদার লোকেরা বলেনঃ তার ( ইসতাওয়া ) এর অর্থ হলঃ স্থায়ীভাবে অবস্থান করা ...। মুজাসসিমাদের এই কথা বাতিল বা নষ্ট একটি কথা । যায়গাতে অবস্থান গ্রহণ করা দেহের গুণ এবং তা থেকে হুলুল এবং সীমা অপরিহার্য হয় সুতরাং তা আল্লাহ্ র ক্ষেত্রে অসম্ভব বরং তা মাখলুকের জন্য উপযুক্ত । ( ফাতহুল বারী - ১৩/৪৮৩ )
এখানে আরেকটা বিষয় , কর্মগত সিফাত বা সৃষ্ট কোন গুণ আল্লাহ্ তালার সত্ত্বার মাঝে সম্পাদন হওয়া, এটা যে কত জঘন্য আকিদা । তা আশা করি যারা ( الحوادث لا تقوم بذات الله تعالى ) এই মূলনীতি নিয়ে পড়েছেন তাদের কাছে স্পষ্ট । এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ এবং আহলে সুন্নাত ও জামাতের মাঝে উল্লেখিত মূলনীতির ইখতেলাফের প্রভাব “ইসতাওয়া” এর মাঝেও পড়েছে । আল্লাহ্ তাওফিক দিলে আরেকদিন লিখবো । ইন সা আল্লাহ্ ।
ইখতেলাফের খুলাছাহঃ
অর্থ করা হবে, না হবে না, এই দৃষ্টিকোণ থেকে দুই মাজহাব ।
১ – অর্থ করা হবে না । তখন আয়াতের অর্থ হবেঃ আল্লাহ্ আরশে ইসতাওয়া ।
২ – অর্থ করা হবে ।
তবে “ইসতাওয়া” এটা কি আল্লাহ্র সত্ত্বাগত সিফাত না কর্মগত সিফাত । এই দৃষ্টিকোণ থেকে দুই মাজহাবঃ
ক – সত্ত্বাগত সিফাত তখন অর্থ হবেঃ আল্লাহ্ আরশে সমুন্নত ।
খ – কর্মগত সিফাত । এখানে কয়েকটি মাজহাব রয়েছে । তবে প্রসিদ্ধ দুটিঃ
১ - কর্মগত সিফাত এবং ইসতাওয়া এর অর্থ হল ( استولى ) প্রভাব বিস্তার করা । তখন আয়াতের অর্থ হবেঃ আল্লাহ্ আরশের উপর নিজ ক্ষমতা বা প্রভাব বিস্তার করলেন ।
২ - কর্মগত সিফাত এবং ইসতাওয়া ( اسْتَوَى ) শব্দটির অর্থ হলঃ
ক - আরোহণ করা ।
খ - ঊর্ধ্বগমন করা ।
গ - স্থানগত ভাবে সমুন্নত হওয়া ।
ঘ - স্থায়ীভাবে অবস্থান করা ।
তখন আয়াতের অর্থ হবে আল্লাহ্ আরশে আরোহণ করলেন বা উঠলেন । ইত্যাদি ।
আকিদার খোলাছাহঃ
সর্বোত্তম আকিদা হলঃ "ইসতাওয়া" শব্দটির কোন অর্থ গ্রহণ না করে এভাবে বলা, আল্লাহ্ আরশে ইসতাওয়া । এটাই উত্তম এবং এটার নিরাপদ । আমার আকিদাও এটা । আলহামদুলিল্লাহ্ ।
অথবা কেউ ইচ্ছা করলে ইসতাওয়া শব্দটিকে সত্ত্বাগত সিফাত ধরে, “ইসতাওয়া” শব্দটির অর্থ করতে পারেন, আল্লাহ্ ( মর্যাদাগত দিক থেকে ) আরশে সমুন্নত ।
অথবা ইসতাওয়া শব্দটিকে আল্লাহ্র কর্মগত সিফাত ধরে এভাবে অর্থ করতে পারেন, আল্লাহ্ আরশের উপর নিজ ক্ষমতা বা প্রভাব বিস্তার করলেন । এই দুটি মতের পক্ষেও সালাফদের অনেকে পাওয়া যায় ।
কিন্তু আল্লাহ্ র কর্মগত সিফাত ধরে ইসতাওয়া শব্দের অর্থ করা,
আরোহণ করলেন বা আরশে উঠলেন বা স্থানগত ভাবে আল্লাহ্ আরশে সমুন্নত বা আল্লাহ্ স্থায়ীভাবে আরশে অবস্থান করেন বা আল্লাহ্ আরশে বসলেন । ইত্যাদি
এগুলোর কোনটাই আহলে সুন্নাত ও জামাতের আকিদা নয় । এটা ছিল মুজাসসিমা বা দেহবাদীদের আকিদা । যার অনুসরণ করছে নামধারী সালাফিরা । এবং হানাফী নামধারী কিছু জাহেলকে দেখা যায় এই আকিদা রাখে এবং হানাফি আকিদা বলে প্রচারও করে । নাউজুবিল্লাহ । এবং তার মত আরো কিছু জাহেল এটাকে হানাফী আকিদা মনে করে । নাউজুবিল্লাহ । অথচ হানাফি মাজহাবের ফতুয়া অনুযায়ী এই আকিদা স্পষ্ট কুফুরি আকিদা । যা আমি “বর্তমান সালাফিদের সালাফ বিরোধী আকিদা” তে দলিল সহ উল্লেখ করেছি । আলহামদুলিল্লাহ্ ।
এখানে “ইসতাওয়া” সম্পর্কে প্রসিদ্ধ মতগুলো উল্লেখ করা হল । তবে কেউ যদি আরো বিস্তারিত মুলাতা করতে চান, তাহলে জানাবেন ইন সা আল্লাহ্, বিস্তারিত ভাবে জানার মত কিছু কিতাবের নাম বলবো । এবং আমার ও এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত ভাবে লেখার ইচ্ছা আছে । আল্লাহ্ তাওফিক দান করুন । আমিন ।
নামধারী সালাফিদের গোমরাহি আকিদা থেকে নিজে বাঁচুন অন্যকে বাঁচান ।
جزاكم الله خيرا
বেলাল বিন আলী


No comments